প্রথম সন্তানের সময় গর্ভকালীন কোনো চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পাননি কক্সবাজারের বাসিন্দা আস্তেফা বেগম। প্রসবের জন্যও ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। কয়েকজন প্রতিবেশি, গ্রাম্য কবিরাজ আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন একজন ধাত্রীই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। তাদের উপস্থিতিতেই আস্তেফার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। ভূমিষ্ঠ হলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায় সন্তানটি। সন্তানের মৃত্যু আর কবিরাজের চিকিৎসার টাকা, দু’য়ে মিলে দিশেহারা হয়ে যান আস্তেফা আর তার দিনমজুর স্বামী আব্দুল করিম।
আস্তেফা বেগম (২২ বছর) কক্সসবাজার চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। ২০১৯ সালে, প্রথম সন্তান জন্মদানের সময় আস্তেফা আর করিমের অর্থনৈতিক অবস্থা আর সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল বেশ নাজুক। আশেপাশেও ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক গর্ভকালীন সেবা ও সন্তান জন্মদানের সুযোগ।
আস্তেফা দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভবতী হন ২০২১ সালে। এবার প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি আর গর্ভকালীন সেবার খোঁজ করেন তিনি আর তার স্বামী। প্রতিবেশীদের থেকে জানতে পারেন গর্ভবতী মায়ের সেবাদানের জন্য কৈয়ারবিল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সাফল্যের কথা। যোগাযোগের পর জানা গেলো, দক্ষ মিডওয়াইফের সহায়তায় শুধু সন্তান জন্ম দেয়াই যায় না, সেখানে রয়েছে গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবাও। আস্তেফা তিনবার প্রসূতি মায়ের জন্য নির্ধারিত প্রসব পূর্ব স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেন।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রসব ব্যথা নিয়ে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পৌঁছান আস্তেফা। হাসপাতালের মিডওয়াইফরা আস্তেফার সর্বোচ্চ গর্ভকালীন সেবা নিশ্চিত করেন এবং একটি সুস্থ সন্তান জন্মগ্রহন করে। সেই সাথে মিডওয়াইফগণ ঝুঁকিমুক্ত প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য আস্তেফার পছন্দ অনুসারে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবস্থাও প্রদান করেন।
স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র থেকে সন্তান নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আস্তেফা বলেন, ‘প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর আমারা ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমাদের জন্য টাকাপয়সা যোগাড় করা একটা বড় সমস্যা ছিল। এখানে কখনো একটা টাকাও প্রয়োজন হয়নি। প্রথমবার আসার পরই আমাদের একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলা হয়েছিল, যে কোনো বিপদে যে কোনো সময় নিজে এসে বা ফোনে যোগাযোগের করলে সেবা দেয়া হবে। আমরা প্রথমবারের মতো বাবা মা হলাম। এ আনন্দ বলে তো আসলে প্রকাশ করা সম্ভব না।’
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় হেলথ ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সহায়তা করছে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ । প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের ৬ উপজেলায় জরায়ু ক্যান্সার পরীক্ষা করা হয়। সে সাথে ৪৫ টি ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি, প্রসূতির জরুরি অবস্থার সেবা, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা প্ল্যান ও পদ্ধতি প্রদান সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সেবা প্রদানের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে রয়েছেন এক বা একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত দক্ষ মিডওয়াইফ।
বিচক্ষণতার সাথে মিডওয়াইফ পদায়ন করার ফলে গত দুই বছরে কক্সবাজার জেলায় ৪৫ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বেড়েছে শতকরা ৭৫%। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। তাই, মিডওয়াইফারদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি এবং ইউনিয়ন পর্যায় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে পদায়ন বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুর হার শূন্যে নামিয়ে এনে এসডিজি’র লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে।