রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় গত এক বছরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের অবদান
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/Volunteer%20Traditional%20Midwives-5_1.jpg?itok=Yw4opcOG)
এক বছর আগে (২৫ আগস্ট ২০১৭) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শুরু করে। নতুন শরণার্থীরা আগে থেকে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে যুক্ত হওয়ার কারনে খুব দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে তৈরি হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকট! এই শরণার্থীদের মধ্যে ছিল হাজার হাজার অন্তঃস্বত্তা নারী এবং অসংখ্য নারী ও শিশু। তখন অগণিত নারী ও মেয়েশিশু ছিল সহিংসতার ঝুঁকিতে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অনতিবিলম্বে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের সাহায্য করার জন্য তাদের কর্মকান্ডের পরিধি বাড়িয়ে দেয়।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/PhotoForTweetWHD_0.jpg?itok=SR-eUHTi)
মর্যাদা সুরক্ষা দিয়ে শুরু
রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতেই ইউএনএফপিএ তার বিশেষায়িত ও নিজস্ব উদ্যোগ “ডিগনিটি কিট” সংগ্রহ এবং বিতরণ শুরু করে। এই ডিগনিটি কিটের মধ্যে ছিল নারীদের ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, যেমন পরিধেয় কাপড়, পরিষ্কার অন্তর্বাস, সাবান এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি। রোহিঙ্গা নারীরা যখন তাদের পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দেয়, তখন তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের কোনো জিনিসই আনতে পারেনি, পরিধেয় কাপড় হয়ে গিয়েছিল জড়াজীর্ণ , ছেঁড়া, তাতে তাদের মর্যাদা সুরক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের মর্যাদা সুরক্ষার প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই ডিগনিটি কিট। ইউএনএফপিএ এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৪ হাজার ডিগনিটি কিট রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী মেয়েদের মাঝে বিতরণ করেছে।
যে কোন দুর্যোগের সময় "নারীবান্ধব সেবা কেন্দ্র" অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সেবা কার্যক্রম। আর তাই দূর্যোগকালীন সময়ে ইউএনএফপিএর কাছে নারীবান্ধব সেবা কেন্দ্র স্থাপন অগ্রাধিকার পায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবিরগুলো আগে যেখানে বন-জংগল ছিল এমন জায়গায় গড়ে উঠেছে। তাই সেখানে কোন স্থাপনা তৈরি করতে হয়েছিল শূন্য থেকে, যা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। কিন্ত তারপরেও আমরা এই নারীদের জন্য নিরাপদ নারীবান্ধব সেবা কেন্দ্রগুলো তৈরি করেছি - যাকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা "শান্তিখানা" বা "শান্তির ঘর" বলে ডাকে। এই শান্তিখানায় রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েরা আমাদের কেসওয়ার্কারদের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে, কোন ভয়ভীতি ছাড়াই তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে এবং নিজেদের জীবনের গল্প একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে। কক্সবাজার জেলায় আমাদের ২০তম নারীবান্ধব সেবা কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রতিদিন শত শত নারী আসে একটু শান্তির পরশ পেতে।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/Volunteer%20Traditional%20Midwives-24_0.jpg?itok=kgqUpYHp)
নারীবান্ধব সেবাকেন্দ্র গুলোতে আমরা মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা নারীদের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি— যা তাদের এত বড় সঙ্কটের পর স্বাভাবিক হতে সাহায্য করছে। জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের শত শত কেসওয়ার্কারকে প্রশিক্ষিত করেছেন। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেও অনেক স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষিত হয়েছেন। যার ফলে তারা সহজেই নিজেদের সম্প্রদায়ের নারী ও কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারছেন। আমাদের স্থানীয় কেসওয়ার্কাররা লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার (জিবিভি) কেস ম্যানেজমেন্ট এর উপর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই উচ্চ মানের কেস ম্যানেজমেন্ট সেবা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আমাদের কর্মীরা যে কোনো জটিল বিষয়ে সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এর ফলে হাজার হাজার নারী ইতোমধ্যেই মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তারা এখন ভবিষ্যতের দিকে নজর দিতে পারছেন এবং পরবর্তীতে কিভাবে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন তা ভালভাবে শিখে নিতে পারছেন।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/one%20year%20on-1_1.jpg?itok=en3EIQLH)
নিরাপদ প্রসব
গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ছিলেন অন্তঃস্বত্তা নারী। একটি পুরো প্রজন্ম ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরনার্থী শিবিরে জন্ম নিয়েছে। মা এবং নবজাতকের জীবন বাঁচাতে ও তাদের সুস্থ রাখতে প্রায় ১০০ জন প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ নিযুক্ত রয়েছে। এ পর্যন্ত, ইউএনএফপিএ পরিচালিত সরকারি ও বেসরকারি সেবা কেন্দ্রগুলিতে প্রায় ৪ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। মিডওয়াইফরা আমাদের ফ্রন্টলাইন কর্মী, তবে তাদেরকে চিকিৎসক ও স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্যে উল্লেখযোগ্য পরিমান ওষুধ সরবরাহ সহ, প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণের জন্য ফার্মাসিস্টও নিয়োগ করা হয়েছে।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/one%20year%20on-18_0.jpg?itok=45yByS7o)
ইতোমধ্যে ১৩০ জন কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের অনেকেই দাই বা ধাত্রী এবং সমাজে তারা মর্যাদার অধিকারী। তাদের এ জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে তারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে গর্ভবতী নারীদের চিহ্নিত করতে পারেন এবং তাদের পরিবারকে এটা বোঝাতে পারেন যে, একজন দক্ষ মিডওয়াইফের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার উপকারিতা এবং কত বেশী ফলপ্রসু। আনন্দের ব্যাপার হলো, এই স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে ক্যাম্পে অনেক রোহিঙ্গা মা ও নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের ভলান্টিয়ার প্রো্গ্রামের আওতায় স্বেচ্ছাসেবীরা কাজের বিনিময়ে ভাতা পায়। আরও অধিক সংখ্যক মায়েদের এ ধরনের সেবা দিতে আগামীতে এই স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/Volunteer%20Traditional%20Midwives-22_0.jpg?itok=NEVUTOPw)
আমরা সকল অন্তঃস্বত্তা নারীদের "ক্লিন ডেলিভারি কিট" সরবরাহ করি, যাতে তারা কোন হসপিটাল বা ক্লিনিকে যেতে না পারলে, বাড়িতেই নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারে। এই কিটে রয়েছে পরিষ্কার কাপড়, টাওয়েল এবং নাড়ি কাটার জন্য জীবানুমুক্ত ব্লেড। নতুন কোন শিশু জন্ম নেওয়ার প্রাক্কালে মাকে আরেকটি কিট দেওয়া হয় যা ”মামা কিট” নামে পরিচিত। এই কিটে থাকে তুলা, শিশুর জামাকাপড়, একটি কম্বল, শিশুর পরিধেয় ন্যাপি এবং মায়ের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/one%20year%20on-1_0_0.jpg?itok=Rj5zHNa7)
এখনও হাজার হাজার নারীরা সন্তান জন্ম দেয় বাড়িতে, যা তাদের এবং তাদের শিশুদেরকে বাড়তি ঝুঁকির মুখে ফেলে। তাই আমরা সকল মায়েদের কাছে মিডওয়াইফারী সেবা পৌঁছে দিতে চাই।
আমরা চাই প্রতিটি শিশুর আগমন হোক নিরাপদ ও আনন্দের, কোন বোঝা হয়ে নয়।
পছন্দমত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহন
চলমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি, নারীদের ন্যায্য অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। তা সত্তেও এই সমাজ ব্যাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এখন আমাদের কমিউনিটি নারী স্বেচ্ছাসেবক, স্বাস্থ্যকর্মী, এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা পুরুষদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে কমেউনিটিতে কাজ করছেন। ইউএনএফপিএ একটি অধিকারভিত্তিক সংস্থা। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহনের ক্ষেত্রে, গ্রহীতার পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে মানসম্মত সেবা প্রদান আমাদের মূল লক্ষ্য। তাই শরণার্থী শিবিরে সে বিষয়টি চিন্তা করে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বা জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। নতুন মায়েদের জন্যও তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাবস্থা রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বা জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রীর সরবরাহ থাকার কারনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী তাদের পছন্দমত পদ্ধতি গ্রহণ করছেন এবং পুরুষেরাও তাদের সমর্থন করছেন।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/one%20year%20on-28_0.jpg?itok=NlBPOXQ7)
সম্প্রতি ইউএনএফপিএ, যুব কর্মসূচির সূচনা করে কর্মপরিধির বিস্তার ঘটিয়েছে, যা ইতোমধ্যেই সারা বাংলাদেশে বেশ সাফল্য পেয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে এবং আশপাশের এলাকাতেওে এই কর্মসূচি সফল হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের যৌন স্বাস্থ্য এবং জীবন দক্ষতার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যৌন নিপীড়ন এবং এর প্রতিরোধ সম্পর্কে তরুণদের জন্য অধিবেশনের আয়োজন করা হচ্ছে, যার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা শরনার্থী শিবিরের অল্পবয়স্ক মেয়েদের প্রায়শই হয়ে থাকে ।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/IYD2018-12_0.jpg?itok=wwa8JJbM)
ইউএনএফপিএর বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতি জনগণের সাড়া অভূতপূর্ব! আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও অংগীকার খুব স্পষ্ট। ইউএনএফপিএ, জাতিসংঘের সংস্থাসমুহের মধে একটি অংগসংস্থা, যা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার ব্যাপারে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়। আমরা এটা করতে পেরেছি কারণ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো এবং অন্যান্য সমর্থকরা আমাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এ জন্য আমরা আমাদের সকল সহযোগী সংস্থাসমূহ ও সমর্থকদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
![](https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/styles/large/public/Volunteer%20Traditional%20Midwives-39_0.jpg?itok=BOhx5LRF)
পরিশেষে বলতে চাই, রোহিঙ্গা সমস্যা একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট। যা কাটাতে বাংলাদেশ সরকারসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘ মেয়াদি ও টেকসই কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তা দূর করতেই হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এর মূল কথা হলোঃ ”কাউকে পিছিয়ে না রাখা”। সেই লক্ষ্য অর্জনেই আমদের এগোতে হবে।